দিনাজপুর প্রতিনিধি :
ভারতীয় ভিসা প্রাপ্তিতে জটিলতা এবং অর্থনৈতিক সংকট – এই দুই কারণে চিকিৎসায় বিদেশমুখী প্রবণতা কমায় এখন দেশের উত্তরের জেলা দিনাজপুর পরিণত হয়েছে হৃদরোগীদের আস্থার নতুন আশ্রয়স্থলে। রোগীদের অভিযোগ, সহজে ভিসা না পাওয়ায় প্রথমত দুশ্চিন্তা হলেও, এখন এটিই যেন তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, এখন দেশেই কম খরচে তারা উন্নত চিকিৎসা পাচ্ছেন, যা বিদেশে গেলে ৫-৬ গুণ বেশি ব্যয়বহুল হতো।
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (দিমেক) এবং জেলার অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সম্প্রতি হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর ভিড় বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত বছরের তুলনায় বর্তমানে রোগী সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
দিনাজপুর সদর উপজেলার রানীপুরের শাহীন আলম ভিসার জটিলতা ও আর্থিক সংকটে প্রথমে ভারতে যেতে পারেননি। দিমেক হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগে ভর্তি হয়ে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে গত ২৪ সেপ্টেম্বর তার হৃদযন্ত্রে সফলভাবে পেসমেকার স্থাপন করা হয়। তার বাবা আজীম উদ্দীন জানান, ভারতে এই চিকিৎসায় খরচ হতো ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা, কিন্তু দিনাজপুরের সরকারি হাসপাতালে খরচ হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ থেকে আসা আরমান আলী বলেন, ভিসা না পেয়ে বাধ্য হয়ে দিমেক হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিয়েছি। চিকিৎসক হার্টে রিং বসিয়েছেন। রিং-এর দাম বাদে আমার খরচ হয়েছে মাত্র ২ হাজার টাকা! তিনি বলেন, “বাংলাদেশেই যে এত অল্প খরচে এই চিকিৎসা, তা ভারতীয় ভিসা পেলে জানতেই পারতাম না।”
দিমেক হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাঃ শাহরিয়ার কবীরকে একজন ভালো চিকিৎসক হিসেবে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন আরমান আলীর বাবা। পাঁচ’শ শয্যার দিমেক হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগে শয্যা সংখ্যা ৯০টি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, এখানে প্রতি মাসে অন্তত ৮০ জন রোগীর অ্যাঞ্জিওগ্রাফি, ২০ জনের স্টেন্টিং (হার্টের রিং) স্থাপন এবং ১০ জনের পেসমেকার স্থাপন করা হচ্ছে, যা বিগত বছরগুলোর চেয়ে অনেক বেশি।
অধ্যাপক ডাঃ শাহরিয়ার কবীর জানান, এই হাসপাতালে অ্যাঞ্জিওগ্রাফি, অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি, স্টেন্টিং ও পেসমেকার স্থাপনের মতো সব কাজই করা হচ্ছে। শুধু বাইপাস সার্জারীর জন্য রোগীদের ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “হৃদরোগের ভালো চিকিৎসা দেশেই সম্ভব, তাই বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।”
হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ মোঃ ফজলুর রহমান স্বীকার করেন, রোগীদের ভারতে যাওয়ার প্রবণতা কমে যাওয়ায় এখানে চিকিৎসা নিতে আসা হৃদরোগীর সংখ্যা বেড়েছে। রোগীদের সেবার জন্য চিকিৎসা সরঞ্জাম বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।
দিমেক হাসপাতাল ছাড়াও দিনাজপুরে বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল এবং কেয়ার স্পেশালাইজড জেনারেল হাসপাতালেও কার্ডিয়াক বেড রয়েছে ৫০টি। জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে বাইপাস সার্জারি, এনজিওগ্রাম, এনজিওপ্লাস্টিসহ হৃদরোগের সব চিকিৎসাই করা হয়।
রংপুরের মুন্সীপাড়ার সাহেরা বেগম জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে দ্রুত চিকিৎসা নিয়ে এখন ভালো আছেন। তিনি বলেন, “দেশেই দ্রুত চিকিৎসা পেয়েছি। ভারতে আর যেতে হলো না। বেশ ভালো লাগছে।
জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের সাধারণ সম্পাদক একেএম আজাদ জানান, ২০০২ সালে কার্যক্রম শুরু হওয়া এই হাসপাতাল দ্রুত চিকিৎসা সেবার কারণে উত্তরাঞ্চলে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ পর্যন্ত এখানে ১ লাখ ২৬ হাজার ১৫১ জন রোগীর চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার উপর আস্থা রেখে ভিসা জটিলতার কারণে যারা বিদেশমুখীতা কমিয়ে দেশের ভেতরে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের এই সিদ্ধান্ত শুধু ব্যক্তিগত অর্থ সাশ্রয় করবে না, বরং দেশের স্বাস্থ্যখাতে নতুন করে আস্থা তৈরি করবে।











