October 24, 2025

শিরোনাম
  • Home
  • অর্থ ও বাণিজ্য
  • বাংলাদেশে কোরিয়ান বিনিয়োগকারীদের সিএসআর কার্যক্রম ও ভবিষ্যৎ সহযোগিতা নিয়ে সেমিনার অনুষ্ঠিত

বাংলাদেশে কোরিয়ান বিনিয়োগকারীদের সিএসআর কার্যক্রম ও ভবিষ্যৎ সহযোগিতা নিয়ে সেমিনার অনুষ্ঠিত

Image

বাংলাদেশে নিযুক্ত কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের দূতাবাসের আয়োজনে রবিবার (১৯ অক্টোবর ২০২৫) রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হয়েছে “Korean Investors’ CSR Activities and Future Together” শীর্ষক সেমিনার। এ অনুষ্ঠানে অংশ নেন কোরিয়ান বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান, এনজিও, ব্যবসায়ী নেতা ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা। সেমিনারে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন এবং কোরিয়া-বাংলাদেশ অংশীদারত্বকে আরও সুদৃঢ় করতে করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি (সিএসআর)-এর গুরুত্ব তুলে ধরা হয়।

সেমিনারের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশে নিযুক্ত কোরিয়ান রাষ্ট্রদূত মি. পার্ক ইয়ং-সিক। তিনি বলেন, সিএসআর এখন কেবল একটি ধারণা নয়, এটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক কল্যাণ এবং দায়িত্বশীল বিনিয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি। তিনি বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) অর্জনে কোরিয়ার সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। রাষ্ট্রদূত পার্ক স্মরণ করেন ১৯৭৯ সালে দেশ গার্মেন্টস ও দেউউ করপোরেশনের মধ্যকার ঐতিহাসিক সহযোগিতার কথা, যা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (RMG) শিল্পের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। তিনি বলেন, কোরিয়ান কোম্পানিগুলো গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে শিল্প ও অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১৪৪টি কোরিয়ান কোম্পানি বাংলাদেশের ২৫৭টি অবকাঠামো প্রকল্পে অংশ নিয়েছে, যার আর্থিক পরিমাণ প্রায় ৮.৮২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

রাষ্ট্রদূত পার্ক কোরিয়ান কোম্পানিগুলোর নানা সিএসআর উদ্যোগের উদাহরণ তুলে ধরেন। তিনি জানান, এলজি ইলেকট্রনিকস “অ্যাম্বাসাডর চ্যালেঞ্জ” ও জাগো ফাউন্ডেশনের সঙ্গে আইটি একাডেমির মাধ্যমে শিক্ষায় অবদান রাখছে। স্যামসাং আরঅ্যান্ডডি ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ শিক্ষার্থীদের জন্য কোডিং, আইসিটি প্রশিক্ষণ ও ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে। উরি ব্যাংক শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবেশ সংরক্ষণে কাজ করছে। দোহওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং আইইউটি শিক্ষার্থীদের জন্য শিল্প প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। ইয়ংওয়ান করপোরেশন চট্টগ্রামের কোরিয়ান ইপিজেডে পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তাদের “ব্লু অ্যান্ড গ্রিন ইনিশিয়েটিভ”-এর মাধ্যমে তিন মিলিয়নেরও বেশি গাছ রোপণ ও ৩৭ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি, নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্যসেবা ও টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট স্থাপনসহ নানা সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

কোরিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (KBCCI) সভাপতি মি. শাহাব উদ্দিন খান তাঁর শুভেচ্ছা বক্তব্যে বলেন, কোরিয়ান কোম্পানিগুলোর বিশেষত্ব শুধু তাদের ব্যবসায়িক সাফল্যে নয়, বরং সমাজ ও মানুষের প্রতি তাদের আন্তরিক দায়বদ্ধতায়। তিনি বলেন, “সিএসআর এখন কোরিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্বের সেতু হিসেবে কাজ করছে।” স্যামসাং, ইয়ংওয়ান, হুন্ডাইসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবেশ সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে বলে তিনি জানান। তিনি KOICA ও অন্যান্য কোরিয়ান সংস্থার সহযোগিতার প্রশংসা করেন, যারা এই কার্যক্রমগুলোকে দীর্ঘমেয়াদে ফলপ্রসূ করে তুলছে।

সেমিনারে এলজি ইলেকট্রনিকস, স্যামসাং আরঅ্যান্ডডি ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ, উরি ব্যাংক, দোহওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং ও ইয়ংওয়ান করপোরেশনের প্রতিনিধিরা তাদের বিভিন্ন সিএসআর উদ্যোগ উপস্থাপন করেন। পাশাপাশি কোরিয়ান এনজিও যেমন সেভ দ্য চিলড্রেন কোরিয়া, অক্সফাম কোরিয়া, হ্যাবিট্যাট কোরিয়া, গুড নেবারস, এডরা কোরিয়া ও গ্লোবাল কেয়ার বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলমান সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে।

সেমিনারে মূল বক্তব্য প্রদান করেন সিএসআর সেন্টারের চেয়ারম্যান ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব অ্যাম্বাসেডর ফারুক সোবহান। তিনি বলেন, “সিএসআর দান নয়, এটি একটি কৌশল। যখন কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসায়িক মডেলে সিএসআরকে অন্তর্ভুক্ত করে, তখন তারা দীর্ঘমেয়াদে মুনাফা, সুনাম ও স্থিতিশীলতা অর্জন করতে পারে।” তিনি বলেন, “লাভ, সুনাম ও সমাজ — এই তিনটি একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কর্মীদের কল্যাণ, কমিউনিটির উন্নয়ন ও প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি—সবকিছুই সিএসআরের মাধ্যমে একীভূত হয়।”

অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে KOICA বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মি. জিহুন কিম ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আমরা কোরিয়ান বিনিয়োগকারীদের অনুপ্রেরণামূলক উদাহরণ শুনেছি। তাদের উপস্থাপনা সাধারণ দান-সাহায্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে কৌশলগত সিএসআর উদ্যোগ দেখিয়েছে, যা বাংলাদেশের সমাজকল্যাণের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। দক্ষতা উন্নয়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষাসহ এ হলো এমন করপোরেট দায়িত্ব যা সমৃদ্ধি ভাগাভাগি করে।”

তিনি আরও বলেন, কোরিয়ান কোম্পানি এবং এনজিওরা মূল মাঠে কাজ করছে, দূরবর্তী ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ এলাকায় আশার বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। এই উদ্যোগগুলো KOICA-এর ODA প্রোগ্রামের সঙ্গে সম্পূরকভাবে কাজ করছে, যা “ক্লেক্টিভ ইমপ্যাক্ট” বা যৌথ প্রভাব নিশ্চিত করছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি জানান, যখন KOICA কোনও ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার গড়ে তোলে এবং কোনো কোরিয়ান কোম্পানি তার সিএসআর উদ্যোগের মাধ্যমে চাকরির ব্যবস্থা বা বিশেষ সরঞ্জাম সরবরাহ করে, তখন প্রভাব বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। এছাড়া জাতীয় স্বাস্থ্য উদ্যোগে অর্থায়ন করলে কোরিয়ান এনজিওরা স্থানীয় স্বাস্থ্য শিক্ষা দিয়ে জীবন বাঁচাচ্ছে।

মি. কিম আরও বলেন, আমরা আরও বেশি পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে এবং আমাদের উন্নয়ন কার্যক্রমকে সম্পূরক করার জন্য স্পষ্ট ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি উল্লেখ করেন, এই সিএসআর ও এনজিও উদ্যোগগুলো সরাসরি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো যেমন দারিদ্র্য হ্রাস, মানসম্মত শিক্ষা, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন, এবং যোগ্য কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সংযুক্ত। এ উদ্যোগগুলো বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের দিকে নিয়ে যাওয়া জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গির সাথেও পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ।

তিনি সমাপনী বক্তব্যে অংশগ্রহণকারীদের অনুপ্রাণিত হওয়ার পাশাপাশি কর্মে মনোনিবেশ করার আহ্বান জানান, যাতে তারা সহযোগিতা গভীর করতে, সেরা অনুশীলনগুলো ভাগ করতে এবং সম্পদ সমন্বয়ের নতুন উপায় খুঁজে বের করতে পারে, যা বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করবে।

এই সেমিনারের মাধ্যমে কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের দূতাবাস দায়িত্বশীল ব্যবসায়িক আচরণ, মানুষকেন্দ্রিক উন্নয়ন ও কোরিয়ান বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও গভীর করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে।

Scroll to Top