বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুস খাদ্য নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার ও টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামোর মৌলিক পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন। সোমবার ইতালির রোমে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব খাদ্য সম্মেলনের (World Food Forum) পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে প্রধান বক্তা হিসেবে তিনি এ আহ্বান জানান।

প্রফেসর ইউনুস তাঁর বক্তব্যের শুরুতে এফএও মহাপরিচালক ড. কিউ ডংইউকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “এফএও’র ৮০ বছর শুধু উদযাপনের সময় নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতিরও আহ্বান।”
এ বছরের থিম “হ্যান্ড ইন হ্যান্ড ফর বেটার ফুড অ্যান্ড এ বেটার ফিউচার” প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “খাদ্য শুধু ক্যালরির হিসাব নয়; এটি মর্যাদার, ন্যায়ের, এবং আমরা কেমন পৃথিবীতে বাস করতে চাই তার প্রতিচ্ছবি।”
প্রফেসর ইউনুস বলেন, “গত বছর বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে গণতন্ত্র, শান্তি ও মানবাধিকারের দাবিতে আন্দোলন করেছিল। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে তরুণ প্রজন্ম — সাহস ও আশায় উজ্জীবিত তরুণরা।”
তিনি আরও যোগ করেন, তরুণরাই এখন নতুন বাংলাদেশ গড়ার নেতৃত্ব দিচ্ছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতা ও ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে।
বাংলাদেশের কৃষি খাতের সাফল্যের কথা তুলে ধরে প্রফেসর ইউনুস বলেন, “আমাদের ভূমির আয়তন ইতালির অর্ধেক হলেও আমরা ১৭ কোটিরও বেশি মানুষকে খাদ্য সরবরাহ করি, পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে পালিয়ে আসা ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকেও আশ্রয় ও খাদ্য দিচ্ছি।”
তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ আজ ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ, এবং বিশ্বের শীর্ষ ধান, শাকসবজি ও স্বাদুপানির মাছ উৎপাদক দেশগুলোর একটি। কৃষিতে ২১৪% ফসল ঘনত্ব, ১৩৩টি জলবায়ু সহনশীল ধানের জাত, এবং ৭০% পর্যন্ত যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি — এসব উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশ কৃষিতে বৈপ্লবিক অগ্রগতি অর্জন করেছে।
প্রফেসর ইউনুস স্পষ্টভাবে বলেন, “ক্ষুধা কোনো খাদ্যাভাবের কারণে নয়, বরং এটি আমাদের নকশা করা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ব্যর্থতা — এটি নৈতিক ব্যর্থতা।”
তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, “আমরা যখন ক্ষুধা নির্মূলে কিছু বিলিয়ন ডলার জোগাড় করতে পারিনি, তখন বিশ্ব অস্ত্র তৈরিতে ব্যয় করেছে ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলার। এটিই কি আমাদের অগ্রগতির সংজ্ঞা?”
তিনি ক্ষুধামুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক বিশ্ব গঠনে ছয়টি কার্যকর প্রস্তাব উপস্থাপন করেন—
১. ক্ষুধা-সংঘাত চক্র ভেঙে যুদ্ধ বন্ধ করে সংলাপ শুরু করা এবং সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে খাদ্য প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা।
২. এসডিজি অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি পূরণ ও জলবায়ু সহনশীলতা জোরদার করা।
৩. আঞ্চলিক খাদ্য ভাণ্ডার (Regional Food Banks) গঠন করে সরবরাহ শৃঙ্খল স্থিতিশীল রাখা।
৪. তরুণ উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন, অবকাঠামো ও বৈশ্বিক অংশীদারিত্বে ক্ষমতায়ন করা।
৫. খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা পরিহার ও বাণিজ্যনীতির সংস্কার।
৬. প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সুযোগ সকল দেশের, বিশেষত গ্লোবাল সাউথ ও গ্রামীণ যুবকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
তিনি বলেন, লাভ-সর্বাধিকায়নের পুরনো অর্থনৈতিক মডেল সমাজে বৈষম্য ও অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এখন সময় এসেছে সামাজিক ব্যবসা (Social Business) ভিত্তিক নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ার।
তিনি তাঁর স্বপ্নের “তিন-শূন্য বিশ্ব” (Three-Zero World) ধারণা তুলে ধরেন—
- শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীকরণ, দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য
- শূন্য বেকারত্ব, সবার জন্য উদ্যোক্তা সৃষ্টি
- শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ, পৃথিবী রক্ষার জন্য
প্রফেসর ইউনুস বলেন, “এটি কোনো কল্পনা নয়, এটি বাস্তব প্রয়োজন — পৃথিবীকে রক্ষার একমাত্র পথ।”
তিনি বলেন, “আজকের তরুণ প্রজন্ম আগের চেয়ে অনেক বেশি উদ্ভাবনী ও প্রযুক্তি-সচেতন। তাদেরকে চাকরির অপেক্ষায় নয়, চাকরি সৃষ্টির ক্ষমতায়ন করতে হবে। চলুন তাদের বলি—তোমরা চাকরি প্রার্থী নও, তোমরাই চাকরি সৃষ্টিকারী।”
তরুণ উদ্যোক্তা, নারী, কৃষক ও প্রযুক্তি উদ্ভাবকদের জন্য সামাজিক ব্যবসা তহবিল ও অ্যাগ্রি-ইনোভেশন হাব গঠনের আহ্বান জানান তিনি।
প্রফেসর ইউনুস বলেন, “বাংলাদেশ গর্বের সঙ্গে বৈশ্বিক সহযোগিতাকে সমর্থন করে। আমরা গ্লোবাল অ্যালায়েন্স এগেইনস্ট হাঙ্গার অ্যান্ড পোভার্টি’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং জি-২০ কাঠামোর আওতায় এফএও’র সঙ্গে বাস্তব ও কার্যকর সহায়তায় কাজ করছি।”
শেষে তিনি বলেন, “এই ফোরামের তিনটি স্তম্ভ — যুব, বিজ্ঞান ও বিনিয়োগ — শুধুমাত্র স্লোগান নয়, এগুলোই আমাদের সমাজ ও খাদ্যব্যবস্থা রূপান্তরের হাতিয়ার। আজকের পৃথিবীতে সম্পদ আছে, প্রযুক্তি আছে — এখন দরকার সৃজনশীল ধারণা, যা এই প্রযুক্তিকে মানবকল্যাণে ব্যবহার করবে। আমরা যদি কল্পনা করতে পারি, আমরা তা সৃষ্টি করতেও পারব।”











