বাংলাদেশের পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (PRI) এবং যুক্তরাজ্যের ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (UKID) যৌথভাবে আজ মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর ২০২৫) গুলশানের হোটেল আমারিতে “বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতার অপরিহার্যতা” শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনা আয়োজন করে।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী মি. আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রধান অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, “কোনো প্রতিষ্ঠান হয় স্বাধীন, নয়তো নয়—আংশিক স্বায়ত্তশাসন বলে কিছু নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিত না হলে অর্থনীতি সঠিকভাবে চলবে না। এটি শুধু আমার ব্যক্তিগত মত নয়, বরং আমার রাজনৈতিক দলেরও আনুষ্ঠানিক অবস্থান। আমাদের আমলে আমরা কখনো রাজনৈতিক নিয়োগের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করিনি। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যতই অভিজ্ঞ হোন না কেন, তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকিংয়ের মতো বিশেষজ্ঞ ক্ষেত্রের বিকল্প হতে পারেন না।” তিনি আরও বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সত্যিকার অর্থে কার্যকর করতে হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (FID) বিলুপ্ত করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।”
সভাটি সভাপতিত্ব করেন ড. সাদিক আহমেদ, ভাইস চেয়ারম্যান, পিআরআই। উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি বলেন, “ফিলিপস কার্ভে যেমন দেখা যায়, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রবৃদ্ধির মধ্যে স্বল্পমেয়াদি একটি ভারসাম্য থাকে। সরকার সাধারণত প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে মনোযোগ দেয়, কিন্তু একটি স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাজনৈতিক চাপমুক্ত থেকে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার দিকেই গুরুত্ব দেয়।”
মূল প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন ড. আশিকুর রহমান, প্রধান অর্থনীতিবিদ, পিআরআই। তিনি বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা বহুদিন ধরেই আলোচ্য বিষয়। তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়—যখন মুদ্রাস্ফীতির প্রত্যাশা নিম্ন পর্যায়ে থাকে, মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রিত হয় এবং বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকে, তখনই মুদ্রাস্ফীতি কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এই ধরনের ব্যবস্থাপনা কেবল তখনই সম্ভব, যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশ্বাসযোগ্য হয়, আর সেই বিশ্বাসযোগ্যতা আসে স্বাধীনতা থেকে। ১৯৯০-এর দশক থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার এক গুরুত্বপূর্ণ নীতি হয়ে উঠেছে। অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত রাজনীতির হাতে নয়, যুক্তিনির্ভর পেশাদারদের হাতে থাকা উচিত। যেমন চাণক্য বলেছিলেন, জ্ঞানী মানুষ নিজের ভুল থেকে শেখে, আর প্রাজ্ঞ ব্যক্তি অন্যের ভুল থেকে শিক্ষা নেয়। রাজনীতিকদেরও অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আর্থিক খাতের উন্নয়নে সচেষ্ট হতে হবে।”
আলোচনায় অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন—মি. আব্দুল হাই সরকার, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (BAB); ড. মোহাম্মদ আখতার হোসেন, প্রধান অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংক; ড. ফাহমিদা খাতুন, নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি; মি. সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, সভাপতি, এলএফএমইএবি; ড. এম. মসরুর রেজা, চেয়ারম্যান ও সিইও, পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশ; এবং মি. শওকত আজিজ রাসেল, সভাপতি, বিটিএমএ।
প্যানেল বক্তারা বলেন, প্রকৃত অর্থে স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং রাজস্ব আধিপত্য থেকে অর্থনীতিকে সুরক্ষিত রাখতে সহায়তা করবে। ড. আখতার হোসেন বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সরকারের অধীনে থেকে স্বায়ত্তশাসিত হতে হবে, পুরোপুরি স্বাধীন হওয়া উচিত নয়।” ড. ফাহমিদা খাতুন চারটি কারণ তুলে ধরেন কেন স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজন। তিনি বলেন, “রাজনৈতিক সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে স্বাধীনতার আইন পাস করার এবং তা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের। আর্থিক খাত অর্থনীতির প্রাণশক্তি; এর সুরক্ষা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।”
মি. সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক ও ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন ডিভিশনের (FID) সহাবস্থান অপ্রয়োজনীয়। বাংলাদেশকে আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে হবে। আমাদের দরকার পূর্ণ স্বাধীনতা, কেবল স্বায়ত্তশাসন নয়। প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা নির্ভর করে নেতৃত্বের উপর, তাই গভর্নর নিয়োগ প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ ও মেধাভিত্তিক।” ড. মসরুর রেজা বলেন, “বাংলাদেশে মুদ্রানীতির স্পষ্ট ভূমিকা ও আইনি কাঠামো থাকতে হবে, যাতে সরকারকে সরাসরি ঋণ দেওয়া নিষিদ্ধ করা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক নিজস্ব বাজেট নির্ধারণ করবে। তবে মূল বিষয় হলো—রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এটি না থাকলে কোনো সংস্কারই সফল হবে না।”
মি. শওকত আজিজ রাসেল রসিক ভঙ্গিতে বলেন, “এখন দেশে ব্যাংকের সংখ্যা মুদি দোকানের চেয়েও বেশি মনে হয়। এসব ‘মাশরুম ব্যাংক’ খোলার কারণে তহবিলের খরচ বেড়ে গেছে। মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকই যেন একমাত্র লাভজনক প্রতিষ্ঠান।” মি. আব্দুল হাই সরকার বলেন, “স্বাধীনতার পাশাপাশি জবাবদিহিতাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।”
ওপেন ফ্লোর আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা জোরদারে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও সুশাসন কাঠামো নিয়ে মতবিনিময় হয়। সমাপনী বক্তব্যে ড. জায়েদি সাত্তার, চেয়ারম্যান, পিআরআই বলেন, “আমাদের এমন একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক দরকার, যা সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে এবং প্রবৃদ্ধিবান্ধব নীতি গ্রহণ করবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা একটি আদর্শ অবস্থা, তবে এটি বাস্তবায়ন রাজনৈতিকভাবে সহজ নয়। বর্তমানে বাজেট ঘাটতির ৪০% বিদেশি উৎস থেকে মেটানো হয়, যা ইতিবাচক। বাকি অংশ সরকার ও ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিয়ে পূরণ করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া মানেই টাকা ছাপানো, যা মুদ্রাস্ফীতি বাড়ায়। অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ায় বেসরকারি খাতে তহবিল সংকট তৈরি হয়। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের স্পষ্ট অগ্রাধিকার থাকা জরুরি—প্রথমে মূল্য স্থিতিশীলতা, এরপর আর্থিক স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধি, যা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব।”











